এডমিশন টিউন https://www.admissiontune.com/2021/07/the-age-of-earth.html

মহাবিশ্বের বয়স ও দূরবীনের ভূমিকা

দূরবীন দূরের জিনিস কাছে নিয়ে এসে দেখাতে সাহায্য করে। বিজ্ঞানী গ্যালিলিও প্রথম দূরবীন দিয়ে পর্যবেক্ষণের পরপরই বিজ্ঞানীদের মাঝে মহাবিশ্বের নানা অজানা বিষয় জানার কৌতূহল বাড়তে থাকে। তখন থেকেই মূলত মহাবিশ্বের বয়স নির্ধারণ নিয়ে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ শুরু করেন। কিভাবে তাঁরা মহাবিশ্বের বয়স নির্ধারণ করেছিলেন এবং এই কাজে দূরবীনের ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।    
মহাবিশ্বের বয়স ও দূরবীনের ভূমিকা, মহাবিশ্বের বয়স, দূরবীনের ভূমিকা, মহাবিশ্বের বয়স কত, বিজ্ঞানী হাবল

দূরবীন দিয়ে দেখা

বিশ শতকে এসে মহাকাশ নিয়ে মানুষের গবেষণা বিপুলভাবে এগিয়েছে। ক্রমে ক্রমে তৈরি হয়েছে বিশাল আকারের সব আলোক দূরবীন। মহাকাশের নক্ষত্রলোক থেকে আসা ক্ষীণ আলোকে বহুগুণে বাড়িয়ে তুলতে পারে এসব দূরবীন। মাউণ্ট পালোমার-এ বসানো হয়েছিল হেল দূরবীন; তার প্রতিফলক আয়না চওড়ায় ২০০ ইঞ্চি। সম্প্রতি হাওয়াই দ্বীপে বসানো হয়েছে আরো বড়মাপের কেক দূরবীন; এর আয়না চওড়ায় দশ মিটার বা প্রায় ৪০০ ইঞ্চি। আলোক দূরবীন ছাড়াও তৈরি হয়েছে বিশাল বড় আকারের বেতার দূরবীন। এরা ধরতে পারে আরো দূর থেকে আসা বেতার তরঙ্গকে। এই শতাব্দীর মাঝামাঝি মানুষ পৃথিবীর বাঁধন কাটিয়ে মহাকাশে পাঠিয়েছে যন্ত্রপাতিতে ঠাসা রকেট আর নভোযান। ১৯৬৯ সালে পৃথিবী ছাড়িয়ে চাঁদের বুকে গিয়ে নেমেছে মানুষ। সেখানে তারা বসিয়ে আসে নানা যন্ত্রপাতি। তারপর থেকে অসংখ্য নভোযান পৃথিবীর চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি নিয়ে; দিনরাত সংগ্রহ করছে মহাকাশ সম্বন্ধে নানা খরব। 

পৃথিবীর ওপর আজকাল বড় বড় দূরবীন বসানো হয় সচরাচর কোন উঁচু পাহাড়ের ওপর বিজন জায়গায় যাতে আশপাশের লোকালয়ের কৃত্রিম আলোর দূষণ মহাকাশ থেকে আসা অতি ক্ষীণ আলোর হদিস করতে অসুবিধে না ঘটায়। কিন্তু তবু বায়ুমণ্ডলের ধুলো আর মেঘের ঢাকা একেবারে এড়ানো পৃথিবীর বুক থেকে কিছুতেই সম্ভব নয়। এর একমাত্র সমাধান হল মহাকাশে নভোযানে দূরবীন বসানো। মহাকাশে বায়ুমণ্ডল নেই, তাই সেখানে দূরবীনের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসারও কোন সমস্যা নেই। ১৯৯০ সালের শুরুতে স্পেস শাটল থেকে মহাকাশে বসানো হল ‘হাবল’ নামে এক শক্তিশালী দূরবীন। এই দূরবীনটি বিশাল আকারের─দৈর্ঘ্য ৪৩ ফুট, ব্যাস ১৪ ফুট; এর প্রতিফলক আয়না চওড়ায় ২.৪ মিটার বা প্রায় ৯৫ ইঞ্চি; ওজন প্রায় এগারো টন। কেক দূরবীন তৈরিতে খরচ পড়েছিল ১০ কোটি ডলার; অথচ হাবল দূরবীন তৈরিতে খবর হয় ১৬০ কোটি ডলার।

কিন্তু এত খরচ পড়লে কি হবে, হাবল দূরবীন মহাকাশে স্থাপন করার পর পরই টের পাওয়া গেল এর প্রতিফলক আয়নায় রয়ে গেছে মারাত্মক ত্রুটি। সেগুলো মেরামতের চেষ্টা পৃথিবীর ওপর থেকে কম্পিউটারের নির্দেশ দিয়ে কিছুটা করা হল, কিন্তু তাতে সামান্য মাত্র উন্নতি হল; তাই দূরের গ্যালাক্সিদের তেমন স্পষ্ট ছবি পাওয়া যাচ্ছিল না। ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বর মাসে নভোযানের সাহায্যে এক দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে তার আয়না সমাবেশ মেরামত করা হয়েছে। তার ফলে পৃথিবীর ওপরকার যে কোন দূরবীনের চেয়ে বহুগুণে স্পষ্ট ছবি পাওয়া যাচ্ছে এই দূরবীন থেকে। আর এ থেকে যেসব খবরাখবর পাওয়া যাচ্ছে তা আজ অনেকখানি বদলে দিচ্ছে মহাকাশ সম্বন্ধে মানুষের ধারণাকে। 

মহাবিশ্বের বয়স নির্ধারণ

মহাকাশ সম্বন্ধে আজকের সবচেয়ে তাজা খবর হল মহাবিশ্বের বয়স নিয়ে। এ বিষযে এই শতাব্দীর বিশের দশকে মার্কিন জ্যোতির্বিদ এডউইন হাবল বেশ কিছু গবেষণা করেছিলেন। দূরের গ্যালাক্সিদের আলো দূরবীন দিয়ে পরীক্ষা করে ১৯২৯ সালে তিনি দেখেন তাতে কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে─ আলোর ঢেউগুলোর দৈর্ঘ্য যেমন থাকার কথা তার চেয়ে যেন কিছুটা লম্বাটে হয়ে পড়ছে; অর্থাৎ আলোর রঙ বদলে যাচ্ছে লালের দিকে। এমন হওয়া সম্ভব গ্যালাক্সিগুলো যদি আমাদের থেকে দূরে ছুটে যেতে থাকে। দেখা গেল পৃথিবী থেকে সব দিকেই গ্যালাক্সির আলোতে রয়েছে এমনি বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ সব গ্যালাক্সি আমাদের ছায়াপথ বিশ্ব থেকে কেবলই দূরে ছুটে চলেছে। এ থেকে সৃষ্টি হল বিস্ফোরণশীল মহাবিশ্বের তত্ত্ব। অর্থাৎ সুদূর অতীতে কোন এক অতি ছোট বিশ্বডিম্ব থেকে এক বিশাল বিস্ফোরণে এই মহাবিশ্বের গ্যালাক্সিপুঞ্জের সৃষ্টি হয়েছিল, তারপর থেকে সেগুলো কেবলই পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু সত্যি যে এভাবে ছোট এক বিশ্বডিম্ব থেকে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে তার কী কোন প্রমাণ আছে? ষাটের দশকের মাঝামাঝি (১৯৬৪) দুই মার্কিন বিজ্ঞানী আর্নো পেনজিয়াস আর রবার্ট উইলসন আকস্মিকভাবে আবিষ্কার করলেন মহাবিশ্বের চারপাশ থেকে আসা ক্ষীণ বেতার গুঞ্জন। এর নাম দেওয়া হল মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণ। সর্বক্ষণ মহাবিশ্বের চারপাশ থেকে পৃথিবীর ওপর এসে পড়ছে এই বিকিরণ। এবার মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব আরো জোর পেল। বলা হল সুদূর অতীতে যে মহাবিস্ফোরণ ঘটেছিল বিশ্বচরাচরে সবদিকে সমানভাবে বিস্তৃত পটভূমি বিকিরণ হল তারই অবশিষ্ট। বিজ্ঞানীরা পেলেন এক নতুন আলো; মনে হল এবার বুঝি তাঁরা সৃষ্টি রহস্যের প্রায় গোড়ার কাছে পৌঁছে গেছেন।
মহাবিশ্বের বয়স ও দূরবীনের ভূমিকা
এই মহাবিস্ফোরণটা আজ থেকে ঠিক কতকাল আগে ঘটেছিল তার হিসেব কি বের করা যায়? সেটা বের করার জন্য বিজ্ঞানীরা গ্যালাক্সিদের ছুটে চলার বেগের একটা হিসেব করলেন। তা থেকে মহাবিশ্বের বয়সের হিসেবটা পাওয়া গেল মোটামুটি দেড় হাজার থেকে দু’হাজার কোটি বছর। হাবল-এর আবিষ্কার মানুষকে মহাবিশ্বের জন্ম সম্বন্ধে নতুন অন্তর্দৃষ্টি দিয়েছে। উনিশ শতক পর্যন্ত মানুষের বিশ্ব ছিল শুধু সৌরজগৎ আর ছায়াপথকে নিয়ে; হাবল মানুষকে দাঁড় করিয়ে দিলেন এক বিশাল মহাবিশ্বের নাগরিক হিসেবে। তাই ১৯৯০ সালে মহাকাশে যে বড়মাপের দূরবীন বসানো হল তার নাম রাখা হয়েছে হাবল-এর নামে।

এখানেই মানুষের প্রশ্ন তোলা থেমে থাকল না। এরপর যে প্রশ্ন দেখা দিল সে হল : এই যে গ্যালাক্সিপুঞ্জের ক্রমাগত পরস্পরের কাছ থেকে ছুটে চলা সে কি অনন্তকাল ধরে চলতেই থাকবে? একদল জ্যোতির্বিজ্ঞানী বললেন, হ্যাঁ, ঠিক তাই। আরেক দল বললেন, আসলে গ্যালাক্সিগুলো আজ বিস্ফোরণের ধাক্কায় বাইরের দিকে ছুটে চলছে বটে, তেমনি আবার তাদের মধ্যে কাজ করে যাচ্ছে পারস্পরিক আকর্ষণের টান। এই টানে গ্যালাক্সিগুলোর ছুটে চলার বেগ ক্রমে স্তিমিত হয়ে আসবে, তারপর একদিন তারা ছুটবে ভেতরের দিকে। অবশেষে কোন সুদূর ভবিষ্যতে তারা আবার এক বিন্দুতে পৌঁছে যাবে, তখন ঘটবে আরেক প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। কিন্তু এভাবে আকর্ষণের টানে গ্যালাক্সিদের ভেতরের দিকে ফিরে আসতে হলে মহাবিশ্বে যত বস্তু থাকা দরকার পরীক্ষা থেকে কিছুতেই তার হদিস পাওয়া গেল না। বিজ্ঞানীরা বললেন, আসলে মহাবিশ্বে যতটা বস্তু আমরা দেখতে পাই তার চেয়ে অন্তত দশগুণ বস্তু আছে অদৃশ্য কৃষ্ণবস্তুর আকাবে। এই অদৃশ্য বস্তুদের ধরলে গ্যালাক্সিদের আবার ভেতর দিকে ফিরে আসার হিসেব মেলে। 

নব্বইয়ের দশকে আজ হাবল দূরবীন থেকে মহাবিশ্বের অনেক দূরের নিখুঁত ছবি পাওয়া সম্ভব হয়ে উঠেছে। সেসব তথ্য হাবল-এর নিজের আগের অনেক সিদ্ধান্তকেই পালটে দেবার উপক্রম করেছে। হিসেব কিছুতেই মিলছে না।
 
হাবল দূরবীন থেকে পাওয়া নতুন এসব ছবি থেকে গ্যালাক্সিদের দূরে ছুটে যাবার বেগ নতুনভাবে হিসেব করা হচ্ছে। তাতে দেখা যায় মহাবিশ্বের বয়স আগে যতটা ভাবা হয়েছিল ততটা নয়। আগে বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছিলেন, ১,৫০০ থেকে ২,০০০ কোটি বছর আগে এক অতি ছোট অথচ প্রচণ্ড উষ্ণ গোলকে বিপুল বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে মহাবিশ্বের জন্ম। প্রশ্ন উঠবে এই সময়ের হিসেবটা কিভাবে পাওয়া গেল? আসলে ব্যাপারটা তেমন জটিল নয়। হাবল তাঁর পরীক্ষা থেকে বলেছিলেন গ্যালাক্সিরা আমাদের কাছ থেকে যত দূরে, তাদের দূরে ছুটে যাবার বেগ তত বেশি। কাজেই আমাদের জানতে হবে মাত্র দুটি সংখ্যা : কত বেগে গ্যালাক্সিরা একে অন্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছে; আর এখন তারা আমাদের কাছ থেকে কতটা দূরে রয়েছে। এই দুটো সংখ্যার অনুপাতকে বলা হয় ‘হাবল-এর ধ্রুবক’। গ্যালাক্সির আলো যত বেশি লালের দিকে হবে তত বেশি তার বেগ। কাজেই গ্যালাক্সিগুলো কত দূরে সেটা জেনে নিয়ে তাদের চলার বেগকে এই দূরত্ব দিয়ে ভাগ করলেই পাওয়া যাবে মহাবিশ্বের প্রসারের হার; আর তা থেকে পেছন দিকে গেলে পাওয়া যাবে কতদিন আগে এই প্রসারণ শুরু হয়েছিল।

অবশ্য ব্যাপারটা এভাবে শুনতে যত সহজ মনে হচ্ছে, আদতে ঠিক অতটা সহজ নয়। মহাকাশে এসব হিসেব বের করার বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। অনেক দূরের গ্যালাক্সিগুলো পৃথিবী থেকে ঠিক কত দূরে তার হিসেব করা বেশ কঠিন। এমনিতে বোঝা যায় যে, তারারা আমাদের থেকে যত দূরে তাদের তত কম উজ্জ্বল দেখাবে; কিন্তু খুব বেশি দূরের তারাদের দেখতে পাওয়াই শক্ত। এজন্য বিজ্ঞানীরা সচরাচর শেফালি বিষম তারা নামে একজাতের তারাদের দূরত্ব আর উজ্জ্বলতাকে মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করেন। এই তারাদের বৈশিষ্ট্য হল এদের উজ্জ্বলতা একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর পর্যায়ক্রমে বাড়ে কমে; আর এই বাড়া-কমার সময় তাদের প্রকৃত উজ্জ্বলতার সমানুপাতিক। কাজেই এদের বাড়া-কমার সময় মেপে তাদের উজ্জ্বলতার পরিমাপ পাওয়া যায়; তার সঙ্গে আপত উজ্জ্বলতা মেলালে বেরিয়ে পড়ে এদের দূরত্বের হিসেব। তাই অন্য নক্ষত্র বা গ্যালাক্সির দূরত্ব বের করার জন্য এই তারাদের মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করলেই চলে।
 
কিন্তু এখানেও সমস্যা কম নয়। খুব দূরে শেফালি বিষম তারাদেরও খুঁজে পাওয়া কঠিন; তাছাড়া গ্যালাক্সিগুলো প্রায়ই থাকে দল বেঁধে। এমনি সব গ্যালাক্সির দলের মধ্যে রয়েছে পারস্পরিক আকর্ষণের টান। তাই সাধারণভাবে সব গ্যালাক্সির বিস্ফোরণের ধাক্কায় পরস্পরের কাছ থেকে দূরে ছুটে চললেও কাছাকাছি গ্যালাক্সির মধ্যে আকর্ষণের টানে তাদের ছুটে চলার বেগ বেশ কিছুটা কমে যায়। যেমন আমাদের ছায়াপথ বিশ্বের কাছাকাছি (অর্থাৎ ২৩ লক্ষ আলোক-বছর দূরে) রয়েছে অ্যান্ড্রমিডা গ্যালাক্সি; তার ওপর ছায়াপথ গ্যালাক্সির টান এমন প্রবল যে সেটা এর থেকে দূরে সরে না গিয়ে বরং আকর্ষণের টানে ক্রমেই কাছে চলে আসছে। তাই মহাবিশ্বের বিস্তারের সঠিক মাপ পেতে হলে জ্যোতির্বিদদের তাকাতে হয় খুব দূরের গ্যালাক্সিগুলোর দিকে─ যাতে তাদের বাইরের দিকে ছুটে চলার বেগ দলের ভেতরকার আকর্ষণের চাইতে বেশ কিছুটা বেশি হয়। সেখানে আবার দেখা দেয় আরেক সমস্যা; দূরত্ব যত বেশি হয় সেখানে গ্যালাক্সিদের ছুটে চলার বেগ ঠিকমতো মাপা হয়ে ওঠে তত বেশি শক্ত।

দূরের শেফালি বিষম তারাদের দেখতে পাওয়া বেশ শক্ত বলেই হাবল দূরবীন তৈরির সময় এমনভাবে তার নকশা করা হয় যেন তাতে এ জাতের তারাদের অনেক দূর থেকে দেখা যায়। হাবলের আয়নার সমস্যা মেরামতের পর পরই বিজ্ঞানীরা শেফালি বিষম তারার সন্ধান করতে আরম্ভ করলেন। অতি দূরের যেসব শেফালি বিষম তারা পাওয়া গেল তাদের মাপ থেকে হাবল-এর ধ্রুবকের মান বেরোল ৮০; তাতে একদল বিজ্ঞানী হিসেব করে বললেন, তাহলে পৃথিবীর জন্মের সময়টা ছিল খুব সম্ভব ৮০০ থেকে ১,২০০ কোটি বছর আগে (হাবল ধ্রুবক ৫০ হলে মহাবিশ্বের বয়স হত ১,৫০০ কোটি থেকে ২,০০০ কোটি বছর)। অর্থাৎ মহাবিশ্বের বয়স আগে যা ভাবা হচ্ছিল তার চাইতে এই হিসেব হয়ে দাঁড়াল অনেক কম।

অবশ্য এ নিয়ে হয়তো তেমন কোন সমস্যা হত না। সমস্যা দেখা দিয়েছে এজন্য যে, দূরবীন দিয়ে আমাদের ছায়াপথ গ্যালাক্সিরই কেন্দ্রের কাছাকাছি এমন সব নক্ষত্র দেখা যায় যার কোন কোনটার বয়স ১,৪০০ কোটি বছরের কম নয়। তার মানে দাঁড়ায় এই যে, এই মহাবিশ্বে এমন সব নক্ষত্র ও গ্যালাক্সি আছে যাদের বয়স মহাবিশ্বের বয়সের চেয়েও বেশি। এ যেন বার হাত কাঁকুড়ের তের হাত বিচি! এই আপাত দ্বন্দ্বের নিশ্চয়ই কিছু একটা সমাধান রয়েছে। তবে এর জন্য বিজ্ঞানীদের আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা, আরো বিচার-বিশ্লেষণের প্রয়োজন হবে।
 
সেই সঙ্গে দেখা দিয়েছে আরো এক সমস্যা। মহাবিস্ফোরণের তত্ত্ব অনুযায়ী বিস্ফোরণের পর পর বিস্ফোরণের ধাক্কায় সব বস্তুপুঞ্জের চতুর্দিকে সমানভাবে ছিটকে যাবার কথা। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে আমাদের চারপাশে প্রায় ষাট কোটি আলোক-বছর ব্যাসের একটি এলাকা জুড়ে যত গ্যালাক্সি রয়েছে─ তার মধ্যে পড়ছে প্রায় এক লক্ষ আলোক-বছর ব্যাসের আমাদের ছায়াপথ গ্যালাক্সিও─ যেন ছুটে চলেছে সব একই দিকে, বহু দূরে কালপুরুষ মণ্ডলের দিকে। আর সে চলার বেগও অতি প্রচণ্ড সেকেণ্ডে প্রায় ৪৩৫ মাইল, অর্থাৎ ঘণ্টায় প্রায় ১৫.৬০ লক্ষ মাইল। এমন বেগে এত বিপুলসংখ্যক গ্যালাক্সিকে একদিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে কেবল কোন প্রবল মহাকর্ষের টান। কিন্তু এমন প্রবল আকর্ষণ সৃষ্টি করবে এমন বিশাল বস্তুমালার কোন হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।

সমস্যার সেখানেই শেষ নয়, আমাদের গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ-বিশ্ব তার নিজের দলের মধ্যে সরছে এক দিকে; মহাবিস্ফোরণের ফলে মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণের মধ্যে ছুটছে আরেক দিকে; আবার কোন অতি প্রবল আকর্ষণের টানে গ্যালাক্সিপুঞ্জের বিরাট দঙ্গল নিয়ে কালপুরুষ মণ্ডলের দিকে ছুটে চলা─ সে আবার অন্যদিকে। একই গ্যালাক্সি কি একই সঙ্গে এতদিকে ছুটতে পারে? বুঝি আসছে আরেক বিপ্লব

মহাকাশ-তত্ত্বের অনেক প্রশ্নের মীমাংসা বিজ্ঞানীরা বিশ শতকে এসে খুঁজে পেয়েছেন। আবার অনেক প্রশ্নেরই স্পষ্ট জবাব বিজ্ঞানীদের এখনও জানা বাকি। যেমন মহাকাশ জুড়ে যে বিপুল পরিমাণ অদৃশ্য কৃষ্ণবস্তুর অস্তিত্ব কল্পনা করা হচ্ছে তা কী দিয়ে তৈরি? মহাকাশে কৃষ্ণবস্তু আছে ঠিক কতটা পরিমাণে? সেসব মহাকাশ জুড়ে কিভাবে ছড়ানো? ধরা যাক সুদূর অতীতে এক মহাবিস্ফোরণের ফলে সৃষ্টি হয়েছিল এই মহাবিশ্বের; তাতে বিস্ফোরণের দাপটে বস্তুপুঞ্জ চারপাশে ছড়িয়ে পড়ার কথা সমানভাবে। কিন্তু তা না হয়ে এত সব বস্তু জমাট বেঁধে গ্যালাক্সি আর গ্যালাক্সির জোট তৈরি হল কি করে? -এবার এসব প্রশ্নের সঙ্গে যোগ হয়েছে আরো দুটি নতুন প্রশ্ন : মহাবিশ্বের বয়সের চেয়ে তার ভেতরকার কোন কোন তারার বয়স বেশি হয় কি করে? আর মহাকাশের বিশাল একটা এলাকা কেন কালপুরুষ মণ্ডলের দিকে ছুটে চলেছে?

কৃষ্ণবস্তুর কথাই ধরা যাক। মহাকাশে যে প্রচুর অদৃশ্য কৃষ্ণবস্তু আছে তার অস্তিত্ব বোঝা যায় অনেক গ্যালাক্সির ওপর তাদের মহাকর্ষের প্রভাব থেকে। এখন মনে করা হচ্ছে মহাকাশে নক্ষত্র, গ্যালাক্সি ইত্যাদি নব মিলিয়ে যতটা দৃশ্য বস্তু আছে তার চেয়ে এমনি অদৃশ্য বস্তু আছে অন্তত দশগুণ বেশি; কারও কারও হিসেবে এ হিসেবটা একশগুণও হতে পারে। মহাবিশ্বে কৃষ্ণবস্তুর মান বোঝাতে ‘ওমেগা’ নামে একটা প্রতীক চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। এটা হল মহাবিশ্বের যতটা কৃষ্ণবস্তুর হদিস পাওয়া যাচ্ছে তার সঙ্গে যতটা কৃষ্ণবস্তু থাকলে মহাবিশ্বের বিস্তার একসময় থেমে যাবে তার অনুপাত। ওমেগা যদি ১-এর বেশি হয় তাহলে মহাবিশ্বে একদিন চুপসে গিয়ে আর এক মহাবিস্ফোরণ ঘটবে। আর যদি ওমেগা ১-এর কম হয় তাহলে মহাবিশ্ব অনন্তকাল ধরে প্রসারিত হতেই থাকবে।

এই ওমেগার মান কত তার সঙ্গে মহাবিশ্বের বয়সের একটা সম্বন্ধ রয়েছে। ধরা যাক ওমেগার মান বেশ বড়, তাহলে মহাবিশ্বের বয়স আপাত যতটা মনে হয় তার চেয়ে বেশ কম হতে পারে। কারণ প্রথম দিকে হয়তো বিস্ফোরণের ফলে বিস্তারটা ঘটেছিল খুব দ্রুত; তাতে মহাবিশ্ব আজকের অবস্থায় আসতে তেমন বেশি সময় লাগে নি। তারপর বিপুল পরিমাণ কৃষ্ণবস্তুর আকর্ষণের কারণে প্রসারণের হার হয়তো বেশ কমে গিয়েছে। সেই হারটাই আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি। অন্যভাবে দেখলে কিছু কিছু তারার বয়স যে মহাবিশ্বের বয়সের চেয়ে বেশি মনে হচ্ছে তার হিসেব মেলাতে হলে ধরতে হয় যে, ওমেগার মান ১-এর একটা ভগ্নাংশ মাত্র; অর্থাৎ মহাবিশ্বের বয়স আপাত যা মনে হচ্ছে আসলে তার চেয়ে ঢের বেশি। কিন্তু তাহলে তো মহাবিশ্ব চিরকাল কেবল প্রসারিত হয়েই যেতে থাকবে; সেটা আবার অনেক বিজ্ঞানী মেনে নিতে দ্বিধা করছেন।

মহাকাশের তত্ত্বে আজ যে জটিল সংকট দেখা দিয়েছে তার সমাধান কী শিগগির পাওয়া যাবে? হয়তো যাবে, হয়তো যাবে না। কিন্তু মনে রাখতে হবে আসলে বিজ্ঞান চিরকাল এভাবেই এগিয়েছে। অভিজ্ঞতাই হল মানুষের সব জ্ঞান আর তত্ত্বের ভিত্তি সাদামাটা চোখে দেখলে হয়তো সবটা সত্যি মানুষের চোখে পড়ে না। বিজ্ঞানীর সূক্ষ্ম পরীক্ষা প্রায়শই সাদা চোখে দেখা তত্ত্বকে পালটে দেয়। একদিন মানুষ ভাবত জলা জায়গায় খারাপ বাতাস থেকেই সব রোগের উৎপত্তি হয়; নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা এই সাদা চোখের দেখাতে দিয়েছে উল্টে। এমনি সাদা চোখের অনেক দেখাতেই বিজ্ঞান ক্রমাগত পালটে দেয়, আর তাতেই মানুষের জ্ঞানের পরিধি বেড়ে চলে।

তত্ত্ব আর পরীক্ষার মধ্যে মিল ঘটানোই হল বিজ্ঞানের কাজ। যদি মিল না হয় তাহলে বুঝতে হবে হয় পরীক্ষাটা ঠিকমতো করা হয় নি, অথবা হয়তো তত্ত্বটাই বদলে ফেলার সময় হয়েছে। গরমিল যদি হয়ে দাঁড়ায় বেশ বড়সড় রকমের তাহলে বুঝতে হবে হয়তো আমরা কোন বড় রকম আবিষ্কারের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছি। আগামী দিনে আরো পরীক্ষণ আর পর্যবেক্ষণ ঘটবে। তা থেকে মহাবিশ্বের আরো গভীর সত্য হয়তো উদ্ঘাটিত হবে। 
সবার সাথে শেয়ার করুন
এই পোস্টে 0 জন কমেন্ট করেছেন

এডমিশন টিউন কী?