হৃদরোগ কি, কেন হয়?
হৃদরোগ হওয়ার কারণ
হৃদরোগের কারণ সম্বন্ধে গবেষণা করে চিকিৎসাবিদরা কতকগুলো ‘সম্ভাব্য ঝুঁকির উপাদান’ নির্ণয় করেছেন। তার মধ্যে পড়ে উচ্চ রক্তচাপ, ধূমপান, রক্তে উচ্চ কোলেস্টেরল মাত্রা এবং ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগ। এসব সম্ভাব্য ঝুঁকির উপাদান সম্বন্ধে সতর্ক থেকে সচেতন চেষ্টার মাধ্যমে হৃদরোগের আশঙ্কা কমানো সম্ভব। এভাবে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ার ফলে গত তিন দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হৃদরোগে মৃত্যুর হার কিছুটা কমে এসেছে। তবে নির্মূল করা গেছে তা বলা যাবে না।
অন্যদিকে অনেক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্ভবত হৃদরোগের কারণ সম্বন্ধে সব কথা এখনো জানা যায়নি। হয়তো আরো সম্ভাব্য ঝুঁকির উপাদান রয়েছে যা আমরা এখনও জানি না। যার ফলে এটিকে মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছি। এমনি ধরনের উপাদান খোঁজার চেষ্টা শুরু হয় পঞ্চাশের দশক থেকেই। বিজ্ঞানীদের কাছে প্রথমেই মনে হল চাপযুক্ত বা চিন্তামূলক কর্মজীবন বা জীবন পদ্ধতি যেন হৃদরোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। জীবনযাত্রার ‘স্ট্রেস’ বা পীড়নকে তাঁরা হৃদরোগের একটি কারণ বলে চিহ্নিত করতে আরম্ভ করলেন।
হৃদরোগের উৎস নিয়ে যত গবেষণা
এ ক্ষেত্রে ১৯৬৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সি, এম, পার্কস (C. M. Parkes) নামে একজন বিজ্ঞানীর একটি পরীক্ষার ফলাফল বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। তিনি ৪,৫০০ জন বিপত্নীক (যার স্ত্রী মারা গিয়েছে) ব্যক্তিকে নিয়ে একটি জরিপ করতে গিয়ে দেখলেন তাদের মধ্যে একটা বড় অংশের হৃদরোগে মৃত্যু ঘটেছে স্ত্রীর মৃত্যুর ছ’মাসের মধ্যেই। মনে হল যেন স্ত্রীর মৃত্যুর ফলে যে মানসিক পীড়ন ঘটেছে তাতেই এসব ব্যক্তির হৃদরোগ গুরুতর রূপ নিয়েছে। অবশ্য বিজ্ঞানীরা নানা পরীক্ষা থেকে বললেন, জীবনযাত্রার চাপ ও পীড়নটাই প্রধান কারণ নয়, এই পীড়নে কোন ব্যক্তির মধ্যে কী ধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া ঘটছে সেটাই হল আসল। মোদ্দা কথা আর যাই হোক হৃদরোগের সাথে যে মনস্তাত্ত্বিক একটা সংযোগ রয়েছে তা মোটামুটি বিজ্ঞানীরা স্বীকার করে নিয়েছেন।
এই সময় থেকে সব লোককে ব্যক্তিত্বের ধাঁচ অনুসারে দু’ভাগে ভাগ করা শুরু হয়। একটাকে বলা হয় ‘এ’ ধাঁচ, আরেকটা ‘বি’-ধাঁচ (ইংরেজি বর্ণমালা অনুসারে)। গবেষকরা এই ধাঁচ নির্ণয় করতে লাগলেন সাক্ষাৎকার বা প্রশ্নমালার উত্তরের মাধ্যমে। এ-ধাঁচের লোকেরা কিছুটা আগ্রাসী আর উচ্চাভিলাষী। সব সময় যেন অতি ব্যস্ত এবং কথা বলতে ব্যগ্র। বি-ধাঁচ হল এর ঠিক ‘এ’ ধাঁচের উল্টো।
এ-ধাঁচের লোকদের মধ্যে প্রায়ই এসব লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায় : এক সাথে দু-তিনটে কাজ করতে চেষ্টা করে। দ্রুত হাঁটে, দ্রুত খায়; সব সময় কাঁটায় কাঁটায় নির্দিষ্ট জায়গায় না পৌঁছতে পারলে অস্থির হয়ে পড়ে; কথা বলার সময় চোখ পিটপিট করে’ প্রায়ই হাঁটু কাঁপায় বা আঙুল দিয়ে তাল দেয়, অন্যের কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে কথা বলে; হাত নেড়ে কথা বলে বা কথা বলার সময় জোর দেবার জন্য টেবিল থাপড়ায়; তাড়াতাড়ি হাঁটতে গিয়ে প্রায়ই হোঁচট খায়; কোন কারণে অপেক্ষা করতে হলে বিরক্ত হয়ে ওঠে। বি-ধাঁচের লোকেরা অনেকটা ঠাণ্ডা, ধীরস্থির। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ও কানাডায় কয়েকটি জরিপে দেখা গেছে মধ্যবিত্ত বা উচ্চ-মধ্যবিত্ত বিভিন্ন পেশার লোকদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই হল এ-ধাঁচের।
ষাটের দশকে ফ্রিডম্যান (M. Friedman) নামে দু’জন মার্কিন বিজ্ঞানী ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের বাসিন্দা ৩,৫০০ জন পুরুষকে নিয়ে আট বছর ধরে একটি পরীক্ষা করেন। তাতে দেখা যায়, হৃদযন্ত্রের রক্তনালীর রোগ অন্যদের তুলনায় এ-ধাঁচের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোকদের বেশি হয়। অন্যান্য ঝুঁকির উপাদান ধর্তব্যের মধ্যে না নিলে বি-ধাঁচের লোকদের চেয়ে এ-ধাঁচের লোকদের মধ্যে হৃদরোগ হবার হার দেখা যায় দু’থেকে তিন গুণ। ১৯৮০ সালে হায়েনস (S. Haynes) নামে একজন বিজ্ঞানী আরেকটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেন। তাতে দেখা যায় সমাজের মোটামুটি ওপরের তলার পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে এক ধরনের ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায় যাকে বলা যেতে পারে ‘হৃদরোগপ্রবণ ব্যক্তিত্ব।’
এসব গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হৃদরোগ সমিতি (আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন) ১৯৮১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এ-ধাঁচের ব্যক্তিত্বকে হৃদরোগের একটি নতুন ঝুঁকির উপাদান বলে ঘোষণা করে। তবে সম্প্রতি আরো কিছু গবেষণা হয়েছে যাতে আগেরকার ফলাফলের ব্যাখ্যা নিয়ে কিছুটা দ্বিধা দেখা দিয়েছে।
প্রথমত প্রশ্ন উঠেছে জরিপের পদ্ধতি সম্পর্কে। দ্বিতীয়ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এসব জরিপ থেকে যে ধরনের উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে তা ইউরোপ বা আর কোন অঞ্চলের সামাজিক পরিবেশে একই অর্থ বহন করে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। কতকগুলি আপাত সম্পর্কহীন আচরণগত বৈশিষ্ট্য রক্তনালীর অবস্থার ওপর কেন একই ধরনের প্রভাব বিস্তার করবে তা নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন।
তা ছাড়া যাকে এ-ধাঁচের আচরণ বৈশিষ্ট বলা হচ্ছে পাশ্চাত্য দেশে তা প্রধানত সমাজের উঁচুতলার লোকদের মধ্যেই প্রকাশ পেয়ে থাকে। অথচ সেখানে হৃদরোগ ঘটতে দেখা যায় সমাজে নিচুতলার লোকদের মধ্যেই বেশি। এর একটা কারণ হতে পারে এসব নিচুতলার লোকদের ব্যাপক অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা এবং তার ফলে সৃষ্ট মানসিক পীড়ন। এ এমন এক ধরনের পীড়ন যার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া ব্যক্তির ইচ্ছাধীন নয় এবং যার ফলে অ্যাডরিনাল গ্রন্থি থেকে ‘কর্টিসল’ প্রভৃতি পীড়নজনিত হরমোন নিঃসরণ বৃদ্ধি পায়। একদল কলেজছাত্রের মধ্যে এ-ধাঁচের ব্যক্তিত্ব সম্পন্নদের নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা গেল গণিতের সমস্যা সমাধান করার সময় তাদের এসব হরমোন নিঃসরণ বেশি হচ্ছে। অর্থাৎ কোন না কোন ভাবে গবেষকরা মানসিক পীড়ন বা অত্যধিক চিন্তা করার সাথে হৃদরোগের একটা কানেকশন খুঁজে পাচ্ছে।
হৃদযন্ত্রের রক্তনালীর অবস্থার ওপর এসব হরমোনের কী ধরণের প্রভাব পড়ে তা নিয়ে আরো পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়ার সাথে হৃৎপেশীর পরিবর্তনের কোন সম্পর্ক আছে কি না তা নিয়েও আরো পরীক্ষা প্রয়োজন হবে। তবে এখন পর্যন্ত যা যা গবেষণালব্ধ ফল বেরিয়েছে তা ফলপ্রসূ হয়েছে।
অবশ্য ইতিমধ্যে এ-ধাঁচের আচরণ হৃদরোগের সম্ভাবনা বাড়ায় এমনি একটা ধারণা সম্ভাবত চালু থাকবে। রোগী যদি মনে করে যে, দৈনন্দিন জীবনের পীড়ন তার রোগের একটি প্রধান কারণ, তাহলে সে নিজেই কারণটা কিছুটা দূর করে এ অবস্থার প্রতিবিধানের চেষ্টা করতে পারে। আর তাতে রোগীর উপকার ছাড়া অপকার ঘটবার কোন সম্ভাবনা নেই।
করণীয় কী কী
তবে রোগী যদি তার অতীত ‘জীবন যন্ত্রণা’ এর ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসকের পক্ষে রোগের আসল কারণ, নির্ণয় দুঃসাধ্য করে তোলে তাহলে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। হৃদরোগের রোগীদের - বিশেষ করে যাদের ইতিমধ্যে হৃদবৈকল্য ঘটেছে - তাদের জন্য মানসিক শান্তি ও স্বস্তির অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে। এমন ধরনের রোগীদের দৈনন্দিন জীবন পদ্ধতি অনেক ক্ষেত্রে নানাভাবে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে, রোগীর দীর্ঘকালীন পরিচর্যা পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। সেজন্য এসব রোগীর জন্য প্রায়ই আশ্বাসমূলক মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শের প্রয়োজন দেখা দেয়।
তবে শুধু কোন কৌশলে এ-ধাঁচের আচরণ পরিবর্তন করে বি-ধাঁচের আচরণ আয়ত্ত করতে পারলেই হৃদরোগের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে এমন ধারণা অনেক ক্ষেত্রে এক ধরনের অবাস্তব নিরাপত্তাবোধের জন্ম দিতে পারে। সে সম্পর্কেও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
হৃদরোগ থেকে বাঁচতে হলে করণীয় কী
·
আদর্শ জীবনযাপনের বিধি-বিধান পালন করা।
·
সর্বাবস্থায় তামাক জাতীয় পণ্য (সিগারেট, জর্দা ইত্যাদি)
এড়িয়ে চলা।
·
অ্যালকোহল বা মাদক দ্রব্য পরিত্যাগ করা।
·
প্রতিদিন হালকা ব্যায়াম করা। তা সম্ভব না হলে অন্ততপক্ষে
সকালে ৩০ মিনিট হাঁটা উচিত।
· বেশি শাকসবজি ও সালাদ খাওয়া এবং গিলা, কলিজা, মগজ ও গরু-মহিষের
লাল মাংস পরিহার করা (গরু-মহিষের হালকা গোলাপি বর্ণের মাংস খাওয়া যাবে)।
·
তেল, চর্বি ও মিষ্টি কম খাওয়া।
· চর্বি জাতীয় অনেক খাবার আদর্শ খাদ্য হিসেবে পরিচিত এগুলোর
কিছু ক্ষতিকারক দিক রয়েছে। যেমনঃ দুধ চর্বি ও পানির একটি ইমালশন। ফলে দুধ খাওয়ার পরে
দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে চর্বিকণা লেগে থাকে। তাই চর্বি জাতীয় খাদ্য গ্রহণের পর কুলি করে
নিতে হবে।
· গরুর মাংস খাওয়ার পরে হালকা কুসুম গরম পানি দিয়ে কুলি করলে
দাঁতের ফাঁকে জমে থাকা চর্বিকণা বেরিয়ে যায়। নতুবা এই চর্বিকণা করোনারী ধমনিতে ব্লকের
সৃষ্টি করে যাকে “হার্টের ব্লক” নামে চিনি। এটি
হলে হার্টে রিং (অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতিও আছে) বসাতে হয়।
· আলগা লবণ বর্জন করা। অর্থাৎ খাদ্যে লবণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ
করা।
· উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক ও কিডনির সমস্যা থাকলে
চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া।
· উত্তেজনা প্রশমন করা ও স্থিতিশিলতা বজায় রাখা। দুশ্চিন্তামুক্ত
জীবনযাপন হৃদরোগ প্রশমনের প্রদান উপায়।
· বছরে অন্তত একবার বা সম্ভব হলে দুবার সমগ্রদেহ চেকআপ করা।
· কোন রোগীর হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এই কাজগুলো করতে হবেঃ
üজিহ্বার নিচে নাইট্রোগ্লিসারিন স্প্রে দুইবার চাপ দিতে হবে বা ১টি গ্লিসারাইল ট্রাইনাইট্রেট ট্যাবলেট দিতে হবে।
ü এছাড়া ৭৫ মি.গ্রাম ৪টি অ্যাসপিরিন ট্যাবলেট গুলিয়ে রোগীকে খাওয়াতে হবে।
üআধাশোয়া অবস্থায় হাসপাতালে নিতে হবে এবং দ্রুত কার্ডিওলজিস্টের তত্ত্বাবধানে আনতে হবে। এক্ষেত্রে রোগীকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট বা ভালো মানের যেকোনো হৃদরোগ হাসপাতাল- এ নিয়ে গেলে ভালো হয়।