এডমিশন টিউন https://www.admissiontune.com/2021/05/why-do-people-sleep.html

মানুষের ঘুম পায় কেন?

ঘুম নিয়ে আমাদের সবার কম বেশি ঝামেলা থাকেই। আর এটা ইদানিং এতোটাই প্রকট যে আমরা ঘুম আসে না (বিশেষ করে  রাতে ঘুম আসে না), ঘুমের ব্যায়াম ইত্যাদি লিখে গুগলে হরহামেশা গুগলে সার্চ করতেই থাকি। কিন্তু আমরা কি জানি কেন আমরা ঘুমাই? এর দরকারটা কী? এটা নিয়েই বিস্তারিত বৈজ্ঞানিক আলোচনা করা হয়েছে নিচে।
why-do-people-sleep
কর্মক্লান্ত দিনের শেষে যখন রাত্রির অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসে তখন কোমল উষ্ণ শয্যায় নিদ্রার প্রশান্তি কে না চায়? কোমল শয্যা যে সবার জোটে তা নয়। যাদের গৃহ বৃক্ষতল বা ফুটপাতের কঠিন কংক্রিট, তারা সেখানেই এলিয়ে দেয় শ্রান্ত দেহ; নিদ্রার শান্ত পরশ খানিকক্ষণের জন্য হলেও ভুলিয়ে দেয় তাদের কঠোর জীবন সংগ্রামের দুঃসহ যন্ত্রণা।   

আবার এমন লোকেরও অভাব নেই যাদের উঁচু পালঙ্কের সুকোমল শয্যায় সারারাত আশপাশ করে কাটে নিদ্রাহীন অশান্তিতে। ঘুম আমাদের কেন প্রয়োজন তা বিজ্ঞানীদের ভাবাচ্ছে বহুকাল থেকে। এটা জানা যে, সবার ঘুমের চাহিদা একরকম নয়। ঘুম কম-বেশি পরিমাণে সবার প্রয়োজন।

আমাদের মধ্যে কেউ বা ঘুমকাতুরে, আবার কারও কারও জন্য ঘুম প্রায় হারাম। বাস, ট্রেন কিংবা বিমানে যারা লম্বা পথের যাত্রী তাদের দিন রাত্রির ছন্দ বদলে যায়; এতে করে ঘুমের যে সাময়িক সমস্যা দেখা দেয় তাতে কেউ কাবু হয় বেশি, কেউ ব কম। আবার অনেকে কাজের পালাক্রমে পড়ে বিভিন্ন সময়ে; তাদেরও ঘুমের ছন্দপতন ঘটে। এতে করে আমাদের শরীর ও মনের উপর চাপ পড়ে কম বেশি পরিমাণে। এসব সমস্যা দূর করার জন্য আজ বিজ্ঞানীদের যথেষ্ট মনোযোগ দিতে হচ্ছে ঘুমের রহস্য নিয়ে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, আমাদের ঘুম আসলে দুই ধরণের। এক হল গভীর ঘুম। রাতের বেশির ভাগ সময় আমরা ঘুমাই এমনি ঘুম। এ সময়ে মস্তিষ্ক থাকে নিঃসাড়; আর সজাগ অবস্থায় যেমন মস্তিষ্কের মধ্যে জটিল বিদ্যুৎ স্পন্দনের দাপাদাপি চলতে থাকে, তার বদলে সেখানে তখন বয়ে যায় শান্ত, ধীর বিদ্যুতের ঢেউ। আর এক ধরনের ঘুম হল অগভীর ঘুম। সময়ে অসময়ে, কাজের ফাঁকে ফাঁকে, বিশেষ করে ভোরের দিকে দেখা দেয় এমন ঘুম। এ সময়ে মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে ওঠে, হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়, আর চোখের পাতার তলায় চোখের মণি দ্রুত এদিক সেদিক নড়তে থাকে। বিজ্ঞানীরা এই ধরণের ঘুমের নাম দিয়েছেন , ‘রেম’ ঘুম (র‍্যাপিড আই মুভমেন্ট বা দ্রুত-চোখ-নড়া থেকে এই নাম)। আমরা বেশির ভাগ স্বপ্ন দেখি এই ‘রেম’ ঘুমের সময়। এমন ঘুম থেকে কাউকে ডেকে তুললে বলবে সে স্বপ্ন দেখছিল।

এই দুই ধরণের ঘুম শরীরের ভিন্ন ভিন্ন প্রয়োজন মেটায়। গভীর ঘুমে ঘাটতি পড়লে লোকে অবসন্ন বোধ করে – ঘুম ঘুম ভাব হয়। অগভীর বা রেম ঘুম কম হলে এই ঘুম ঘুম ভাবটা থাকে না, কিন্তু একটানা এমন চলতে থাকলে স্নায়ু বৈকল্য দেখা দিতে পারে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে ওঠে। তখন তার বাড়তি রেম ঘুমের প্রয়োজন দেখা দেয়। অর্থাৎ মনে হয় লোকের গভীর ঘুমের যেমন প্রয়োজন আছে, তেমনি প্রয়োজন রয়েছে অগভীর ঘুমের। কিন্তু প্রয়োজনটা সত্যি সত্যি কী ধরণের?

এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে আবার মোটামুটি দু’রকমের মত আছে। এক ধরনের মতের মোদ্দা কথা হল ঘুম দেহ-মনের শ্রান্তি দূর করে দেহকে সতেজ আর কর্মক্ষম করে তোলে। আরক ধরনের মতের সার কথা : ঘুম দেহকে সর্বক্ষণ সক্রিয় থাকার ঝুঁকি থেকে নিষ্কৃতি দিয়ে তার রক্ষাব্যবস্থার কাজ করে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে ঘুম হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস করে। হৃদরোগ থেকে বাঁচার উপায় হলো দৈহিক চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত  ঘুমানো। 

সাধারণভাবে একটা ধারণা চালু রয়েছে যে, ঘুমের সময় দেহ তার ক্ষয় পূরণ করে নেয়। তবে এই ক্ষয় পূরণের পদ্ধতি সম্পর্কে সুসংগত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব পাওয়া গিয়েছে কেবল অতি সম্প্রতি - সত্তরের দশকের শেষ দিকে। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আয়ান অসওয়াল্ড এবং তাঁর সহমকর্মীরা বললেন শুধু ঘুমের সময়েই দেহ প্রোটিন তৈরি করতে পারে।
why-people-sleep
দেহের সব কলার মূল উপাদান হল প্রোটিন। আবার এই প্রোটিন তৈরি অসংখ্য অ্যামাইনো অ্যাসিড অণুর শেকল দিয়ে। অসওয়াল্ড যা বললেন তার অর্থ হল দিনের বেলা দেহ খাদ্যবস্তু জীর্ণ করে তা থেকে যোগাড় করে নানা ধরনের অ্যামাইনো অ্যাসিড; তারপর রাতে ঘুমের সময় এইসব অ্যামাইনো অ্যাসিড জোড়া দিয়ে দেহ তার প্রয়োজনীয় সব প্রোটিন তৈরি করতে থাকে।

কিন্তু এরপর লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. পিটার মারলিক আর তাঁর সহকর্মীরা এমন একটি পরীক্ষা করলেন যাতে অসওয়াল্ডের তত্ত্ব ধসে পড়ল। তাঁরা দেহে অ্যামাইনো অ্যাসিড তৈরির ধারা অনুসরণ করে দেখলেন সারাদিন ধরে দেহে অ্যামাইনো অ্যাসিড জমতে থাকে এ কথাটা মোটেই সত্যি নয়, দেহ অ্যামাইনো অ্যাসিড গ্রহণ করার প্রায় সাথে সাথেই তা হয় ভেঙ্গে যায় নয়তো প্রোটিনে পরিণত হয়।

আরেকটা ক্ষয় পূরণের তত্ত্ব হল ঘুমের সময় ক্ষয় পূরণ হয় দেহের নয়, মস্তিষ্কের। জেগে থাকার সময়ও দেহ বিশ্রাম নিতে পারে কিন্তু মস্তিষ্ক সেটা পারে না – কারণ তাকে দিনরাত সারাক্ষণ থাকতে হয় অতিব্যস্ত।তাছাড়া ঘুমের অভাব ঘটলে দেহের কর্মক্ষমতা তেমন হ্রাস পায় না, কিন্তু আচরণের ক্ষেত্রে টা যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। অধিকাংশ লোকের তখন শুধু যে ঘুম ঘুম ভাব হয় তা নয়, প্রায়ই তারা হয়ে ওঠে খিটখিটে মেজাজের, এমনকি কখনো কখনো বাতিকগ্রস্ত ও বিভ্রমাক্রান্ত। তাছাড়া এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে 'দীর্ঘ জীবনের জন্য খাদ্য কম খান' বিষয়ক পোস্টটি পড়তে পারেন।

সাধারণভাবে মনে হয় ‍ঘুমের সময়ে মস্তিষ্ক নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। জেগে থাকা অবস্থায় উজ্জ্বল আলো ঝলক মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক প্রবাহে পরিবর্তন ঘটায়। ঘুমন্ত মস্তিষ্কে এ ধরনের পরিবর্তন ঘটে না। এ সময়ে চোখ থেকে মস্তিষ্কে তাড়না পৌঁছে না তা নয়, তবে মস্তিষ্ক তাতে কোন সাড়া দেয় না। হার্ভার্ডে দু’জন বিজ্ঞানী দেখিয়েছেন বিড়ালের মস্তিষ্কে ইন্দ্রিয়ের তাড়না প্রথম এসে পৌঁছায় বাইরের স্তরে -  

এই অংশে ঘুমের সময় সক্রিয় থাকে। তবে যেখানে অনুভূতির মূল বিন্যাস ঘটে মস্তিষ্কের সেই গভীর স্তরে ঘুমন্ত অবস্থায় এসব তাড়না পৌঁছতে পারে না। অনেকে আজীবন সুস্থ থাকার উপায় সম্পর্কে জানতে চান, এই বিষয়ে আমাদের বিস্তারিত পোস্ট রয়েছে।

ঘুমের সময় মস্তিষ্ক এমনি নিঃনাড় থাকার ফলেই জন্ম নিয়েছে ঘুমের দ্বিতীয় ধরনের তত্ত্ব। এসব তত্ত্বের মূল কথা হল দেহের জৈব প্রক্রিয়ার জন্য ঘুমের তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভূমিকা নেই। ঘুমের আসল কাজ হলো দেহকে নিরাপদ রাখা। মানুষের মত জীবদের একটি প্রধান ইন্দ্রিয় হলো চোখ। রাতের আঁধারে এই দৃষ্টি হয়ে পড়ে সীমাবদ্ধ; কাজেই এ সময়ে অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াবার চেয়ে প্রাগৈতিহাসিক কালে নিরাপদ গুহায় আশ্রয় নেওয়া ছিল শ্রেয়। হয়তো বা এ থেকেই ঐতিহ্যগতভাবে উদ্ভব ঘটেছে রাতে গৃহের আশ্রয়ে নিদ্রার। ক্রমে ক্রমে তা মানুষের একটি মজ্জাগত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে মাত্র। এটি আমার ধারণা মাত্র কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নহে।  

বিভিন্ন প্রাণীর নিদ্রা কালেও প্রভেদ রয়েছে প্রচুর। জিরাফের ঘুমের প্রয়োজন মাত্র দু’ঘণ্টার, অথচ শ্লথ ঘুমায় প্রায় বিশ ঘণ্টা। হাতির তিন-চার ঘণ্টা ঘুমালেই চলে; সিংহ ঘুমায় আঠার ঘণ্টা পর্যন্ত। মানুষের মধ্যেও কারো চার-পাঁচ ঘণ্টা ঘুমেই যথেষ্ট হয়, কারো দরকার হয় আট-দশ ঘণ্টা। আবার একটানা দশ দিন যে লোক না ঘুমিয়ে কটিয়েছে মাত্র দশ-বার ঘণ্টা বাড়তি ঘুমেই তার ঘুমের অভাব মিটে যায়।

অবশ্য ঘুমের কাজ শুধু দেহকে খানিকক্ষণের জন্য নিষ্ক্রিয় করে রাখা—এই মতেরও সমস্যা রয়েছে। শুশুকরা একনাগাড়ে বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারে না, কারণ তাতে পানিতে ডুবে মরার ভয় আছে। পানির ওপরে নাক উঁচিয়ে শ্বাস না নিলে তাদের চলে না। শুধু খানিকক্ষণের জন্য দেহকে নিষ্ক্রিয় রাখাই যদি ঘুমের কাজ হত তাহলে শুশুকদের পক্ষে আদৌ না ঘুমানোই হতো নিরাপদ।কিন্তু তা না করে তারা ঘুমায় এক অদ্ভুত উপায়ে। সিন্ধুনদের শুশুকরা এক এক বারে ঘুমায় ৯০ সেকেন্ডের কম সময়, দিনরাতের সর্বক্ষণই এমন ঘুম চলতে থাকে। এক জাতের শুশুকের মগজের অর্ধেক যখন ঘুমায় বাকি অর্ধেকটুকু জেগে থাকে।  

ঘুমের একটা রহস্য আজও কোন মীমাংসা হয়নি – সে হলো স্বপ্ন দেখা। কেউ কেউ বলেন, মানুষ ঘুমায় স্বপ্ন দেখার জন্য। কিন্তু তাহলে প্রশ্ন ওঠে স্বপ্নই বা আমরা কেন দেখি? সে কি জেগে থাকা অবস্থায় যেসব ভুল ছাপ মগজে দাগ কেটেছে সেগুলোকে মুছে ফেলার জন্য? না কি দিনের বেলা যেসব সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়নি, রাতে নিরিবিল সেগুলোর সমাধান খুঁজবার জন্য? অথবা আগামী ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে স্বপ্নের কাল্পনিক জগতে পরখ করে দেখার জন্য? আসলে হয়তো এর কোনটাই নয়।

বিজ্ঞানীদের নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে এটুকু জানা গিয়েছে যে, বয়স্ক মানুষ রাতে স্বপ্ন দেখে দু’ঘণ্টার কম সময়। কিন্তু স্বপ্ন যে মানুষ আদতে কেন দেখে আর স্বপ্ন দেখার জন্য ঘুমেরই বা প্রয়োজন কেন এসব প্রশ্নের এখনো কোন কূল কিনারা হয়নি।
সবার সাথে শেয়ার করুন
এই পোস্টে 0 জন কমেন্ট করেছেন

এডমিশন টিউন কী?